প্রবীরের মুক্তি আলোয় আলোয় !
বিশ্বে এখন বর্ষা।তথ্য বর্ষা।বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। তথ্যের বন্যাও বইছে।বন্যার যা স্বভাব,জল উপচে সব ভাসিয়ে নেয়,জনগণকে কষ্ট দেয় আর ভোগায়।আমরাও সময়ে ভাসছি জোয়ারে,তথ্য জোয়ার।জল জোয়ারের মতই এরও আছে দুটি দিক-ভালো ও খারাপ। একদিকে তথ্য বিস্ফোরণের ফলে জানার ক্ষেত্র ও পরিধির দারুন বিস্তার অন্যদিকে খেয়াল খুশি মত সত্য মিথ্যে তথ্যের ছড়াছড়ি ও ব্যবহার। আনন্দিত আবার আতংকিত,দুই পর্যায় একই সময়ে যুগপত পার করছি আমরা।কিন্তু তথ্য প্রাপ্তির অধিকার আমাদের একসময় ছিলো না,সঠিক তথ্য প্রাপ্তিতে সাংবাদিকগণ গলদঘর্ম হতেন।অবশেষে দেশে তথ্য অধিকার আইন হয়েছে,স্বাধীন তথ্য কমিশন হয়েছে সবই বর্তমান সরকার করেছে।জনগণ উপকৃত হয়েছে। সরকারকে তাই জানাই সাধুবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
তথ্য মহাসড়কে আমরা দুর্দান্ত গতিতে চলাও শুরু করেছি।সারা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নয়া তথ্য প্রযুক্তির প্রেমবন্ধনেদিনকে দিন আমরাও ছুটছি,জাল বুনছি । পিছিয়ে থাকবার জো নেই,দেশের ভিশন পর্যন্ত চেঞ্জ হয়ে গেছে।ডিজিট গুনে আমরা দেশের পরিচয় পর্যন্ত উন্নত উপমায় উপস্থাপন করছি,ডিজিটাল বাংলাদেশ।মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল পৌছবার স্বপ্ন আমরা আত্মস্থ করে ফেলছি প্রায় ।সম্ভব নয় শব্দটিআজ হয়ে উঠেছে সম্ভাবনা।
এই যখন অবস্থা,আমাদের তো খুশির শেষ নাই।বছর দুই আগে অনলাইন এ্যাক্টিভিস্টদের ডাকে সারা দেশের মানুষ শাহবাগে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে,গণজাগরণ মঞ্চ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নৌকা পর্যন্ত মেরামত করে দিয়েছে।দীর্ঘ দিনের কলংকিত অধ্যায় শেষ হতে চলেছে প্রায়।সরকারের দৃঢ় অবস্থান এক্ষেত্রেও আমাদেরকে মুগ্ধ করেছে।আশা আমাদেও আকাশচারী করেছে।মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা বাস্তবায়নে বহুদিনের হারানো পথআমরা খুঁজে পেয়েছি,মনে পেয়েছি সত্য পথে হাঁটার দুর্দমনীয় সাহস।
কিন্তু পথ হাঁটতে গিয়ে অনুধাবন হলো, কাঁটার আঘাত আমাদেরকে বিপর্যস্ত করছে। কাঁটা ঠিকই চিনছি,কোন কাঁটা নামও জানি কিন্তু উপড়ানো যাচ্ছে না।কারণ সরকার ঠিকমত কাঁটা চিহ্নিত করতে পারছে না,ব্যর্থ হচ্ছে।যে গণজাগরণ কর্মীরা রাতদিন দেশপ্রেমের আকুলতায় জেগে থেকে স্বাধীনতাবিরোধীদের ঘুম হারাম করে দিয়েছেন,তারাই কিন্তু একের পর এক ব্লগার বা নাস্তিক আখ্যা পেয়ে খুন হচ্ছেন। মজার কথা হলো,ব্লগাররাই আবার গ্রেফতার হচ্ছেন।
চিন্তার স্বাধীনতা বলবার স্বাধীনতা কে ধর্মের অনুভূতির আঘাত বিষয়ের সাথে গুবলেট পাকিয়ে জনসমর্থনও হত্যার পক্ষে নেয়ার স্বাধীনতাবিরোধীদেও চেষ্টা হালে পানি পাচ্ছে, ষড়যন্ত্রকারীদের অশুভ পাঁয়তারা জোরালো হচ্ছে।সরকার কথা বলছে হয়ত,আমরা শুনতে পাচ্ছি না বা শুনলেও বুঝতে পারছি না যে,সে কথা কার পক্ষে যাচ্ছে! কিন্তু এই ভুল বুঝবার মাঝামাঝি অনেক ব্লগার বা চিন্তাকর্মী আমাদের থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন,খুন হচ্ছেন।চাপাতির কোপে বাংলাদেশের কলিজা ছিঁড়ে নেয়া হচ্ছে।অনেকে বলেন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী তখন নাকি এমনটাই করেছিলো। আমাদের বুদ্ধি মেধা সব অ¯ত্র দিয়ে অস্তগামী করে দিয়েছিলো। আমরা তাই আশঙ্কা করছি এই ভেবে যে সময়টা কত সুন্দর হতে পারতো!
দেশ আমাদের,স্বাধীন দেশ।সরকার আমাদের,প্রগতিশীল সরকার।কিন্তু এ সময় কি না চিন্তার মৃত্যুহচ্ছে,সরকার কিছইু করতে পাছে না,বিচারও হচ্ছে না।যাদের ব্লগার বলে মারা হচ্ছে বেশিরভাগই আবার হিন্দু।সংখ্যালঘু হিসেবে বিষয়টা বেশ সেনসিটিভ, বেশ দুর্ভাবনারও বটে। আমাদের পাশের দেশের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক এবংসরকারের চরিত্র সবই যখন পজিটিভ তখন বিশিষ্ট নাগরিকগণকে হুমকি এবং এ ধরণের টার্গেট হত্যার বিষয়ে দুশ্চিন্তা চলেই আসে,কে কখন খুন হন !
ব্লগার মানে যারা ব্লগ এ লিখেন। অন্যরাও কিন্তু লিখেন।কেউ কাগজে,কেউ ফেসবুক,টুইটার বা অন্য কোথাও । ভিন্নমত থাকতেই পারে,স্বমতের লোকজনও ব্লগে লিখতে পারেন,লিখে থাকেন। শাহবগের সময় প্রগতি আর প্রগতিবিরোধী দু পক্ষেরই ব্লগ ছিলো,চলছিলো।
চিন্তার স্বাধীনতা বা বলবার স্বাধীনতা মানুষের মজ্জাগত। জন মিল্টন তাঁর ‘এরিওপ্যাজিটিকায়’ স্পষ্ট বলেছেন,আমাকে বলবার লিখবার ও বিবেকেরস্বাধীনতা দাও।কিন্তু ইদানিং বাংলাদেশে হঠাৎ করেই চিন্তন বা বলন-কথন নিয়ে নানা নিষেধাজ্ঞা আর বিরোধীতা আসা শুরু হয়েছে।এমনকি ফেসবুক স্টাটাসকেও কঠোর ও কঠিন আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারার আওতায় আনা হয়েছে।বিষয়টির যথাযথ ও যথেষ্ট জনসম্পৃক্তি যাচাই বাছাই না হয়ে তথ্য-প্রযুক্তি এ্যাক্ট হয়ে গেলেই, যে কেউ সরকারের সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকবে এমন ভাবনা কিছুটা অমূলক বৈকি। তথ্য প্রযুক্তির অন্যায় ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে আচরণবিধি হতে পারে,সেটা দোষের নয়। কিন্তু অস্পষ্ট আইন হয়ে গেলে পর এ আইনের সঠিক ব্যবহার না হলেই ঘটতে পারে বিপদ,ঘটছে।সেটিই এখন হচ্ছে।যে বিষয় বা যাঁর কথা বলবার জন্য এত কথা তাঁর নামটি বড় শ্রদ্ধার,খুব ভালোবাসার।সাংবাদিক প্রবীর সিকদার,বাংলাদেশের বেশ পরিচিত নাম।
একাত্তরে জমিদার সিকদার পরিবারের ১৪ জনকে হত্যা করা হয়,প্রবীরের বাবাও সেখানে খুন হন। দৈনিক জনকণ্ঠে ‘সেই রাজাকার’ সিরিজ রিপোর্ট লিখে সারা দেশে যিনি রাজাকার বৃত্তান্ত জনসম্মুখে তুলে ধরে স্বাধীনতাবিরোধীদের নির্দিষ্ট করে আমাদের দৃষ্টিতে এনেছেন,ইনি সেই প্রবীর সিকদার।ভয় পেয়ে লুকানো রক্তের জাত তাঁর নয়,তিনি লিখে গেছেন,যা দেখেছেন,জেনেছেন সব।রাজাকাররা তাঁকে আক্রমণ করেছে,বোমার আঘাতে তিঁনি এক পা হারিয়ে পঙ্গু হয়েছেন। শরীরে স্পিøন্টার নিয়ে তবুও তিনি মুক্তিযুদ্ধেরূ কথা লিখে চলেছেন অনবদ্য,সত্য প্রকাশে থামেননি।বাংলাদেশের প্রচলিত সংখ্যালঘু বৈশিষ্ট তার ছিলো না। সে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান,বাংলাদেশের সাহস। তিনি ভয় পাবেন কেন,পাননি।কেউ যদি হিন্দুদের জায়গা দখল করে,সে মৌলবাদী জামাত ইসলামের রাজনীতি করে,এটা প্রচলিত।সাইদীর বিচারের রায়ের পর সারা বাংলাদেশে এরকমই হয়েছে। কিন্তু প্রবীর যদি কখনও ভিন্ন তথ্যও পান,পেয়ে থাকেন-তবে সেটা কি তিনি বলবেন না! অধ্যাপক আবুল বারকাত কি বলেন নি,গবেষনা করে তবেই বলেছেন।ধরে নেয়া যায় তিনি সত্যই বলেছেন। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান এসোসিয়েশনের নেতা যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালের প্রসিকিউটরএডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত যে অভিযোগ করেছেন, তাও কি মিথ্যা ! প্রবীরের তাহলে কি অপরাধ ? সে ব্লগার নাকি সে হিন্দু ! সে বাংলাদেশের মুক্তযুদ্ধেও স্বপক্ষের একজন নির্ভীক কলম সৈনিক।তাঁর জিডি থানা কেন নেবে না!সে কি বাংলাদেশের নাগরিক নয় ! তার নিরাপত্তা যদি বিঘিœত হয় বা সে যদি জীবন বিনাশের আশংকা প্রকাশ করে তবে সে কোথায় বলবে? থানা তাঁর জিডি না নিলে সে জনগণের সাহায্য চাইবে এটাই তো স্বাভাবিক। ফেসবুকে লিখে তিনি সেটা আমাদের জানিয়েছেন বলেই আমরা জেনেছি।আর না হলে কিভাবে জানতাম! ফরিদপুরের খবর কি বাংলাদেশ পুরোটা জানতে পারে?
হঠাৎ থানার পুলিশ ধরে নিয়ে ডিবি তে বসিয়ে রাখা আর এক রাতেই ফরিদপুরে মামলা হওয়ার বিষয়টা বিস্ময়কর নয় হয়ত,কিন্তু অস্বস্তির,খুব অশান্তিরও বটে।কেন কোনও আইনজীবী তাঁর পক্ষে লড়বেন না,আইনজীবি পাওয়া তো তাঁর অধিকার।ওখানকার সিন্ডিকেটি নিয়ম যদি থেকেও থাকে, থাকুক। বাইরে থেকেও সেটা নেয়া যেত,সরকার তাঁকে সে সুবিধা দিতেই পারতো। কিন্তু তাঁর পরিবারকে আদালতে না যেতে হুমকি দেয়া বা তাঁকে নির্যাতন করে পুলিশি জবানবন্দী নেয়ার যে কথা তিনি আদালতে বলেছেন,সাধারণের চোখে সেটা আইনের শাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই পারে! প্রবীরদা কী অস্বীকার করেছে যে তিঁনি কোনও স্ট্যাটাস লিখেন নাই! তাহলে তাঁকে রিমান্ডে নিতে হলো কেন?
প্রশ্ন নয় এগুলো,এগুলো আকুতি।শাসকবর্গ শাসন করবেন,স্বাভাবিক।মুক্তযুদ্ধের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করবেন,সেটা আরও স্বাভাবিক।স্পষ্ট বলছি,অন্যায়ভাবে প্রবীরকে আটকে রাখবেন না ! তিঁনি মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তাঁর পরিবার তো বটেইআমরাও কিন্তু স্বাভাবিক হতে পারছি না!মাননীয় তথ্য মন্ত্রীও বলেছেন,বিষয়টা খুব দুঃখজনক। অতএব,অবিলম্বে প্রবীরকে মুক্তি দিন,প্লিজ !
বন্যার পর পলিমাটি কিন্তু খুব কাজের।তথ্য বন্যার পলি হচ্ছে সত্য,সাহস আর স্বাধীনতা। সেটিতে মুক্তির চাষ হওয়া উচিত,হ্যান্ডকাফের নয় !
জয় বাংলা
রাজীব মীর
সহযোগী অধ্যাপক
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
এই লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজের। এখানে প্রতিক্ষণ ডট কমের কোন নিজস্ব বক্তব্য নেই